দৈনিক সময় সংবাদঃ বোরখাপরা মেয়েটির মতো রূপবতী ‘গাবরাখালী ’ এভাবে আর কতদিন নিজেকে লুকিয়ে রাখবে, ঢেকে রাখবে নিজ রূপ-লাবণ্য! সময়ের ব্যবধানে, প্রয়োজনে একদিন সে হয়তো ঠিকই ধরা দেবে। ঠিক এক সময় ভ্রমণ পিপাসুরা তাকে খুঁজে বের করে নিলো। বাস্তবে ঘটেছেও তাই।
কথা বলছি, ময়মনসিংহ নতুন পর্যটন স্পট গাবরাখালীর কথা। যার অবস্থান জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার কাছেই গাবরাখালী। ময়মনসিংহ শহর থেকে আরেক প্রকৃতিকন্যা স্থল বন্দর যাবার পথে একটু দুর্গম এলাকায় গেলে দেখা দেবে সেই রূপবতী গাবরাখালী! হিজল-করচসহ নানা প্রজাতির গাছের সমারোহ আছে এখানে, যেনো সবুজে আচ্ছাদিত। অনেকটাই মিঠাপানির বন সেই ‘রাতারগুলের’ মতোই।
গাবরাখালী! নিঃসর্গের মাঝে লুকিয়ে থাকা এক অপরূপ বনাঞ্চল। জলের সঙ্গে তার মিতালী। বর্ষার অথৈ জলে সে যেনো নবরূপে জেগে ওঠে। আপন সৌন্দর্যের সবটুকু মেলে ধরে, উজার করে দেয়। এ সময় খুলে পড়ে তার বোরখার ঘোমটাও। আগন্তুক আর পথিকদের কাছ থেকে সে নিজেকে আড়াল করে রাখে ঠিকই, কিন্তু আপন ভূবনের বাসিন্দাদের কাছে সে খুবই আধুনিক-উদার। বনের বিচিত্র সব গাছ, জলচর-স্থলচর-উভচর প্রাণি আর মাছ শিকারীদের নিয়ে তার একান্ত আপন ভূবন।
বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে গাবরাখালী একটি ‘সোয়াম্প বন। সভ্যতার ছোঁয়া বহির্ভূত প্রাকৃতিক এ বনটি যেনো নিসর্গের এক অপরূপ উদ্যান। জলকে ঘিরেই বনটির ’ইকোসিস্টেম’ তথা পুরো অস্তিত্ব নির্ভরশীল। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার একেবারে প্রান্তঃসীমায় এক নির্জন স্থানে তার বেড়ে ওঠা, প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতো বনটি আবহমান থেকে এখনও টিকে আছে, পড়ে আছে প্রকৃতিপ্রেমিদের জন্য!
ময়মনসিংহ -হালুয়াঘাট সড়ক ধরে উপজেলা থেকে উত্তরদিকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দুরত্বের মধ্যেই গাবরাখালী অবস্থান। কিন্তু এরকম এক ব্যস্ত স্থান থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী কীভাবে এটি যে পর্যটকদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেল, সে যেনো এক রহস্য। দুর্গমতার কারণে হয়তো এমনটি হয়েছে। বনের ঢুকলে দেখা যায়, হিজল-করচ-জারুল-বরুন-শেওড়া-বুরি আর কদমের লম্বা লম্বা সারি। গাছগুলো একটি আরেকটিকে ঘিরে ধরেছে আপন ভেবে। শতবর্ষী একেকটি হিজলগাছ নিজের ডালপালা আর পাতা দিয়ে অনেক জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে। গোধূলির নিমুঝিমু আলো-আধাঁরিতে এক একটি হিজল গাছকে মনে হয় গভীর ধ্যানে মগ্ন একেকজন সন্ন্যাসী। বনের ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, মুর্তা, বেত, হুগলা আর শনের ঘন বন। বড়গাছগুলোর নিচের এসব ঝোপঝাড় দেখলে মনে হতে পারে, ছোটবনগুলোকে যেন এরা মায়ের মতো আদরের চাদরে ঢেকে রেখেছে। দিগন্তের ওপারের মেঘালয় পাহাড় তৈরি গভীর দৌত্যনা।
গাবরাখালী জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি বন। বিচিত্র প্রজাতির উদ্ভিদ, জলচর ও স্থলচর প্রাণির এক সমৃদ্ধ আবাসস্থল এ বন। বনের মধ্যে দেখা মেলে উদবিড়াল, গেছো ইদুর, কাঠবিড়ালী, খেকশিয়ালসহ নানা প্রজাতির প্রাণি। অনেক মেছোমাঘও বনের মধ্যে বসবাস করে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। চিল, ঈগল, ডাহুক, কানাবক, বালিহাস আর নানা প্রজাতির পাখি দাপিয়ে বেড়ায় বনের মধ্যে।
বিশেষ করে, শীতকালে পরিযায়ী পাখীর কলকাকলীতে মুখরিত থাকে এ বন। দেশিয় নানা প্রজাতির মাছে ভরপুর বনটি। স্থানীয় জেলেরা এ বনের মধ্যে নানা প্রকার ফাঁদ পেতে মাছ শিকার করে। নানা প্রকার কীটপতঙ্গ খেতে বনের মধ্যে ভিড় জমায় মাছের দল। সবমিলিয়ে নিজের সবকিছু নিয়ে বনটি যেনো এক তৃপ্ত সুখীর প্রতিচ্ছায়া। এ বনটির ব্যাপক প্রচার ও যাতায়াতের উন্নতি ঘটালে এটি হয়তো পর্যটকদের কাছে এক আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হতে পারে।
সম্ভাবনার নতুন দাঁড় প্রান্তে হালুয়াঘাট উপজেলা। দেশের পর্যটন শিল্প কে এগিয়ে নেয়ার জন্যে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন ও হালুয়াঘাট উপজেলা পরিষদ যৌথভাবে হালুয়াঘাট উপজেলার ৫ নং গাজিরভিটা ইউনিয়ন গাবরাগালি গ্রামে ১২৫ একর জায়গায় গড়ে তুলা হচ্ছে পর্যটন এলাকা। ইতোমধ্যে জাইকা থেকে ৪০ লাখ, এডিবি থেকে ১৬ লাখ ও হালুয়াঘাট উপেজলা পরিষদের বরাদ্দকৃত কাবিখা/কাবিটা প্রকল্প থেকে ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়। সর্বমোট ৬৬ লাখ টাকার কাজ বাস্তবায়ন করা হয়। জমির মাপ,রাস্তার কাজ শুরু হয়েছে।
গাবরাখালী সম্পর্কে হালুয়াঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক সায়েম বলেন, রাতালগুলের মতোই এ বনটি। এটা নতুন পর্যটন স্পট হিসেবে বেছে নিতে পারেন প্রকৃতিপ্রেমিরা। তিনি বলেন, এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় এর পরিচিতি খুব একটা নেই। ভ্রমণের জন্য এ স্থান পছন্দের তালিকায় রাখতে পারেন পর্যটকরা। ইতোমধ্যে জাইকা থেকে ৪০ লাখ, এডিবি থেকে ১৬ লাখ ও হালুয়াঘাট উপেজলা পরিষদের বরাদ্দকৃত কাবিখা/কাবিটা প্রকল্প থেকে ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়। সর্বমোট ৬৬ লাখ টাকার কাজ বাস্তবায়ন করা হয়।